প্রত্যেক মানুষই স্বপ্ন দেখে আর মানুষের স্বপ্ন দেখার নেই কোন শেষ। মানুষের সব স্বপ্ন পূরণ হয়না কখনো কখনো সেগুলো রূপনেয় দুঃস্বপ্নে। মানুষ সেই দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন পূরণের আশায়। নাছিমা, অর্ধবয়সী এক মহিলার স্বপ্নের দুঃস্বপ্নের কথা বাস্তবের মত বনর্ণা করা হল -
ছোটবেলার কথা খুব একটা মনে নেই। আমার বয়স যখন ৯ তখন আমাদের তিন ভাই বোনকে নিয়ে আমার মা গ্রামে থাকতেন আর বাবা থাকতেন ঢাকায়, দিনমজুরের কাজ করতেন। তখন মাত্র বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তখন আমাদের সংসারে খুব অভাব। এক বেলা খেলে আরেক বেলা উপোস থাকতে হত। সংসারে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি ছিলেন শুধু আমার বাবা। তার উপার্জনও ছিল খুব কম । আমাদেরকে তেমন খরচ দিতে পারেনি। তখন স্বপ্ন দেখতাম একদিন আসবে যখন প্রত্যেকবেলা পেটভরে খেতে পাব।
আমি ছিলাম বড় মেয়ে তাই সংসারের জন্য আমাকে অনেক কাজ করতে হয়েছে, মাছ ধরা এবং অন্যের জমিতে কাজও করতে হয়েছে। তখন দুইবেলা আমরা খেতে পেতাম আর স্বপ্ন দেখতাম আমাদের সংসারে কোন অভাব থাকবে না। কিন্তু সেই স্বপ্ন হয়ে গেল দুঃস্বপ্ন যখন আমার বয়স ১৪। তখন আমার জীবনে নেমে এল অন্ধকারের ঘনঘটা, আমাদের গ্রামের কেউ আর আমাকে কাজ দিতে চায় না। আমাদের গ্রামে একটা নিয়ম ছিল যে, মেয়েরা একটু বড় হলে তাদেরকে কাজ দেয় না। যখন কাজ পেলাম না তখন আবার শুরু হল অনাহারের দিন।
তার ঠিক ৬ মাস পর আমার এক খালা আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং একটা বাসায় কাজ করতে দেন । যাদের বাসায় কাজ করা শুরু করলাম তারা বিভিন্ন সময়ে কারনে অকারনে খারাপ ব্যবহার এমনকি মারধর করত। আবার বাড়ির পুরুষ কর্তার চরিত্র ভাল ছিলনা। একদিন খালা আমাকে দেখতে যায়, আমি খালাকে সব খুলে বলি এবং এটাও বলি আমি এখানে আর থাকব না । তখন খালা আমাকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
বাড়ি ফিরে আসার পর আমার বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন ৩৫ বছর বয়সী এক লোকের সাথে। বিয়ের পর আমার জীবনে শুরু হল নতুন আরেক কষ্ট। আমার স্বামী ও তার বাবা মা সবাই ঢাকার কেরানী গঞ্জে থাকত। সেখানেই আমার সংসার জীবন শুরু। আমার বিয়েতে যৌতুক হিসাবে গরু দেওয়ার কথা থাকলেও বাবা মা দিতে পারেন নি। এজন্য আমার স্বামী ও শাশুরী অনেক অত্যাচার করেছে। বিয়ের এক বছর এর মাথায় আমাকে আবার কাজে নামতে হয় কারন আমার স্বামীর আয় তেমন ভাল ছিলনা । তখন ছোট ব্যবসা করতে শুরু করলাম কখনও পিঠা বিক্রির কাজ, কখনও তরকারী বিক্রি পড়ে একবার কাপড় বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাপড় বিক্রির কাজে ভাল আয় করেত পারিনি কারণ লেখাপড়া না জানার ফলে হিসাব করতে পারতাম না। সেকারনে আমাকে অনেকে ঠকতে হয়েছে। তখন খুব ইচ্ছে করত লেখাপড়া করতে ।
এখন আমার চার ছেলে এক মেয়ে। ছেলেমেয়েদেরকে লেখাপড়া করাতে পারিনি। তবে তাদেরকে বিভিন্ন কাজে দিয়েছি ভবিষ্যতে কিছু একটা করে চলার জন্য। কারণ কাজ না করলে তাদেরকেও না খেয়ে থাকতে হবে আর সেজন্য তাদের লেখাপড়া করতে দিতে পারছি না। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। লেখাপড়া জানার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। একদিন নারী জীবনের কথা জানতে পারি এবং ভর্তি হই নারী জীবনের বাংলা ক্লাসে।
এখন প্রতিদিন নারী জীবনে ক্লাসে আসি আর রাতে আমার ছেলে মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করি যাতে তারা আমার মত না ঠকে। এখন আমার স্বপ্ন আমার মেয়ে নিজের পায়ে দাড়াঁবে আমার মত কষ্ট করবে না আর আমার ছেলেরা ভাল উপার্জ্জন করবে কারও কাছ থেকে ঠকবে না।
No comments:
Post a Comment