Content of this post: Author expressed her feelings about the lose of her mother and also about how she remembers her mother in her writings
এসএসসি পাস করে যখন কলেজে ভর্তি হই তখনই আমার মা মারা যায়। আমরা ৫ ভাই বোন, আমি সবার ছোট। খুব আদর-যত্নে বড় হয়েছি। তখন কোন দুঃখ, কষ্ট, এবং বাস্তবতা সর্ম্পকে কোন ধারণাই ছিলনা। দুচোখ ভরা ছিল স্বপ্ন। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক ঝড় এসে আমার জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিল।
সে দিন ছিল ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৯ তারিখ, সোমবার। মা আমার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেল। করে গেল আমায় একা। সে দিনটির কথা মনে হলে আমি আর কিছু ভাবতে পারিনা। মনে হয় আমি এখনও বেঁচে আছি কিভাবে? সে রাতের ঝড়ে আমার জীবনটা হয়ে গেল এলোমেলো, আমি হয়ে গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগ্য মানুষের একজন। আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল সব আনন্দ, সব সুঃখ, ভেঙে গেল সব স্বপ্ন। আমি হয়ে গেলাম একা। আমি বুঝতে পারতাম না বাস্তবতা কত কঠিন,পৃথিবী কত নির্মম, নিষ্ঠুর। শুধু একজনকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সব কিছু আছে চারদিকে তবু আমার মনে হয় আমার কিছুই নেই। সারাক্ষণ আমার মনের মধ্যে শুধু শূণ্যতা আর হাহাকার! আসলে আমি যে অমূল্য সম্পদ হারিয়েছি সে অমূল্য সম্পদ কি আর কোনদিন ফেরত পাব?
সেদিন মনে হচ্ছিল অমি আর বাঁচবনা। আমিও চলে যাব মায়ের সাথে। যার জন্য এই সুন্দর ধরণীতে আসা, তাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব? আমি কিন্তু এখনও বেঁচে আছি। কারণ কঠিন বাস্তবতা তো আমাদেরকে মেনে নিতেই হবে।
আমি বেঁচে আছি, জীবন চলছে জীবনের গতিতে। কিন্তু আমি তো পারিনি এক মুহুর্তের জন্য আমার মাকে ভুলে থাকতে। আমার মা আমার শিরা, উপশিরা, প্রতিটি রক্তকণিকায় মিশে আছে। আমি প্রতিটি মুর্হুতে আমার মায়ের শূণ্যতা অনুভব করি। কারও কাছ থেকে কোন আদর পেতে আমার ভালো লাগে না, কেবলি মনে হয় ওদের আদর পেয়ে আমি যদি আমার মাকে ভুলে যাই। আমি অনাদর অবহেলার মাঝে আমার মাকে মনে রাখতে চাই। আমার মা আমার সব। আমি আমার মাকে মনে রেখেই বেঁচে থাকতে চাই! সারা দিন কেটে যায় ব্যস্ততার মাঝে। দিন গিয়ে রাত আসে, সবাই যখন ঘুমে বিভোর কিন্তু আমি কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারিনা। মনে পরে মায়ের সেই হাসি ভরা মুখ, মনে পরে মায়ের সব স্মৃতি। মনে পরে আমি যে এত বড় হয়েছি তখনও মায়ের গলা জরিয়ে না ধরলে ঘুম আসতনা আমার। এক দিনের জন্য কোন আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাইনি। কারণ মাকে ছাড়া আমি ঘুমুতে পারব না তাই।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৯ তারিখ, সোমবার আমার মায়ের মৃত্য হয়। রমজান ঈদের তিন দিন পর। আমার বাবা ব্যবসার কাজে ঢাকাতে ছিল। বোনেরা শ্বশুর বাড়িতে, আর আমার একমাত্র ভাই দেশের বাহিরে থাকেন, ভাবী তাঁর ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। বাড়িতে আমি আর আমার মা ছাড়া আর কোন মানুষ ছিল না। মা অসুস্থ ছিলেন তবে এমন কোন অসুস্থ ছিলেন না যে এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন। আমরা তা কোন দিন ভাবতেও পারিনি। রাত তখন ১১ টা। রাতে খাওয়ার পর আমি আর মা দুজনে শুয়ে আছি। সে রাতে কেন যেন আমার ভয় ভয় লাগছিল! মা আর আমি দুজনেই ঘুমিয়ে আছি। রাত যখন ১টা বাজে তখন হঠাৎ কি এক দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি জেগে দেখি আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি। কিন্তু মা কেমন যেন করছে। আলো জ্বালানো ছিল, আমি উঠে বসে মায়ের মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হয়েছে মা? এমন করছো কেন? তোমার কেমন লাগছে?’ আমার মা আমাকে কখনও নাম ধরে ডাকতেন না, সব সময় ‘মা’ বলে ডাকতেন। মা আমাকে তখনও সানা দিয়ে বলে যে, আমার কিছু হয়নি মা তুমি ভয় পেওনা। আমি কিছু ঝুঝে উঠার আগেই আমার মা চিরদিনের জন্য আমার কাছ থেকে চলে গেল। আর কোন কথা বলতে পারিনি। আমি শুধু কয়েক বার মা মা বলে ডেকেছিলাম। তারপর আর কিছুই বলতে পারলামনা।
পরে দরজা খুলে লোকজন ঘরে ঢুকে দেখে আমি মাকে জরিয়ে ধরে মায়ের বুকের উপর অজ্ঞান হয়ে আছি। আমার যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি সকাল হয়ে গেছে সব আত্নীয়-স্বজন এসে গেছে আমাদের বাড়িতে মাকে শেষ বিদায় জানাতে। মা’র চির বিদায়ের আয়োজন করছে সবাই। বাবার জন্যও লোক পাঠিয়েছে। এত কিছুর পরও আমি মাকে শেষবারের মত গোসল করিয়েছি অন্যদের সাথে থেকে। আমার মনে হচ্ছিল মাকে তো আর কোনদিন দেখতে পারবো না। আজ যতকিছু করতে হয় আমি সাথে থেকে করব, যাতে আমার মার কোন অযত্ন না হয়। সেদিন আমি আমার মাকে নিজ হাতে সাজিয়েছিলাম। সে দিনের সেই কথা আমি কোনদিন ভুলে থাকতে পারবো না। আমি আজও ভাবী আমি এত কিছু কি করে পারলাম। বড় হলাম, বিয়ে হলো, আমি নিজেই মা হয়েছি। তারপরও আমি আমার মাকে ভুলতে পারবোনা। প্রায় রাতেই মাকে স্বপ্নে দেখে জেগে উঠি। আর তখনি খুব ইচ্ছে করে সেই আগের মত মাকে জড়িয়ে ধরে যদি একটু ঘুমুতে পারতাম। শান্তির সেই ঘুম !
No comments:
Post a Comment