Title of this post: Sidr of Bangladesh in 2007 and my experience by Zannat Ara Amzad Liva
১৯৯১ সালের পর ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়ের আগমনে আবারও তছনছ হল বাংলাদেশ। গত ১৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বরিশালের কাছে বলেশ্বর নদীর মোহনা দিয়ে ভয়ঙ্কর “সিডর” বাংলাদেশ উপকুলে আঘাত হানতে শুরু করে। সারারাত উপকূলের জনপদগুলো তছনছ করে এটি উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। পরবর্তীতে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ‘‘সিডর” উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বৃহস্পতিবার রাত ৩:০০টায় উপকূল অতিক্রম করে। পরে এটি দেশের দক্ষিণ,মধ্যাঞ্চলে স্থল নিম্নচাপ হিসেবে অবস্থান করে এবং শুক্রবার সকাল ৯:০০টার দিকে দুর্বল হয়ে উত্তর, উত্তর- পূর্ব দিক দিয়ে বাংলাদেশের স্থলসীমা অতিক্রম করে।
প্রলয়ঙ্কারী এই ঘূর্ণিঝড়ির আগমন-বার্তা বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আগে থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলে দেশের সর্ব সাধারণকে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব থেকেই বেশকিছু বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। এছাড়াও উপকূলবর্তী অঞ্চলের অনেক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু এত সর্তকতা অবলম্বন করা সত্বেও প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় তার আক্রমনে ব্যর্থ হয়নি। প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রায় ৩৫০০ হাজারেরও অধিক মানুষকে। বিনষ্ট হয়েছে ব্যাপক ঘরবাড়ী, মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সহ গবাদি পশু ও ফসলের। ভয়াবহ এই ঘূর্ণীঝড়ের আতঙ্কে আতঙ্কিত ছিলাম আমরা সারা দেশবাসী। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে হঠাৎ ঘূর্ণীঝড়ের বাতাসের বেগ প্রচন্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় লন্ডভন্ড হতে শুরু করল ঢাকার অনেক এলাকা। আমি ঢাকার খিলগাঁও এলাকার একজন অধিবাসী। সেদিন গভীর রাতে আমার বাড়ীর পাশের গলিতে বিরাট একটি গাছ উপরে পড়ে যাওয়ায় একসঙ্গে উপড়ে পড়ল পুরো এলাকার বৈদ্যুতিক তার। সারা এলাকা নিমিষেই ছেয়ে গেল অন্ধকারে। শুধুমাত্র এই একটি এলাকাই নয় দেশের সব এলাকা ঘিরেই নেমে এল অন্ধকার। চারদিকে অন্ধকারময় অদৃশ্য বাতাসের শো-শো শব্দে কান ভারী হতে লাগল। ভয়ে শিউরে উঠলো গাঁ। এমনি করে নিদ্রাহীন ভাবে কাটালাম অন্ধকারময় প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণীঝড়ের বিমূর্ত এক রাত।
পরদিন সকালেই খবর পেলাম প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের আত্নকাহিণী। ঘূর্ণিঝড়ে স্যালেন্ডার করেছে হাজারও নর-নারী, শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ। এছাড়াও বিধ্বস্ত হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহস্রাধিক ঘরবাড়ি, চাপা পড়েছে অনেক তাজা প্রাণ। মানুষ হারিয়েছে আত্নীয়-স্বজন কেউবা হারিয়েছে প্রিয়জন। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের সর্বত্র ছিল ধূ-ধূ অন্ধকার। চক্রাকারে বিদ্যুতের রো ধরে ছিল পানি স্বল্পতা, বন্ধছিল সরবরাহ। দেশবাসী ভীষণ কষ্টে একই সাথে বিদ্যুৎ, পানি স্বল্পতা ও গ্যাস সরবরাহ ছাড়া দিনযাপন করেছে । এছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিঘ্নিত হয়েছে দেশের অনেক বৃহৎ কাজ। আমি ভোটার আই.ডি কার্ডের একজন ডাটা এ্যান্ট্রি অপারেটর সেদিন শুক্রবার সকাল ৯.৩০ মিনিটে আমাদের ভোটার আই.ডি কার্ডের ডাটা এ্যান্ট্রি অপারেটরদের একটি ট্রেনিং হওয়ার কথা ছিল। আমাদের ট্রেনিং সেন্টার ছিল খিলগাঁও মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। আমি ও আমার বড় বোন, আমরা খিলগাঁও মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ঢুকতেই দেখলাম কলেজের অনেক মূল্যবান গাছ উপড়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়েছে অনেক বৈদ্যুতিক তার। আর এই বৈদ্যুতিক তাড় বিনষ্ট হওয়ার দরুন আমাদের ট্রেনিং এ বিঘ্ন ঘটে। আমরা আমাদের ল্যাপটপ খুলতে পারিনি; অনুশীলন করতে পারিনি গুরুত্বপূর্ন অনেক কাজ। বিঘ্নিত হয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট কানেকশন। শতশত প্রাণ হারানোর সাথে সাথে সারা দেশ হারিয়ে গিয়েছিল অন্ধকারের গভীরে। খবরের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় ঘূনীঝড়ে আহত, নিহতদের দৃশ্য দেখে সর্বক্ষণ হাহাকার করছিল মন। মনকে আর পোষ মানাতে পারিনি। আমিও তো মানুষ, রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ, আমারও মন আছে। কোন রকম ট্রেনিং লেকচারের মাধ্যমেই সেদিনের মত সমাপ্ত হল ট্রেনিং ক্লাস। ট্রেনিং শেষ হওয়া মাত্রই ছুটে গেলাম দানবীয় শক্তির ঘূর্ণিঝড় “সিডর” আক্রান্ত দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলিয় এলাকায়। যেখানে গিয়ে থমকে গেলাম আমি, স্তব্ধ আমার কণ্ঠ। মনে শুধুই প্রশ্ন জাগে প্রকৃতির এ কোন স্টীম রোলার পীষ্ঠ হল নিস্পাপ শিশু-কিশোর, সহায়-সম্বলহীণ মানুষের ওপর? শুধু মানুষই নয়, অবুঝ-নির্বাক পশুরাও নিস্তার পায়নি দানবীয় “সিডর” আক্রমন থেকে। পানির স্রোতে ভেসে উঠেছে বহু মানুষের মৃত গলিত দেহ, বাতাসে পঁচন ধরা লাশের দুর্গন্ধ। এ যেন এক মৃত্যুপুরী। ধ্বংসযজ্ঞ এই সকল মৃত্যুপুরিতে চলছে স্বজনহারানো শোকের মাতন, অন্যদিকে একমুঠো খাবার ও লজ্জা নিবারনের এক টুকরো বস্ত্রের জন্য খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো লাখ লাখ বুভুক্ষু ও শীতার্ত মানুষের হাহাকার। এই মাতম আর হাহাকারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। শুকনো মাটির অভাবে বহু লাশের ঠাঁই হচ্ছে গণ কবরে। অনেক ক্ষেত্রে কাফনের কাপড়টুকু ও ধ্বংস্তুপের মাঝে চাঁপা পড়া মানুষের মৃত দেহ পত্রিকার পাতায় ছবি হয়ে স্থান নিয়ে ত্যাগ করেছে নিঃশ্বাস, ছেড়ে গেছে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী। মর্মান্তিক এই ঘূর্ণিঝড় আমাদের করেছে নিঃস্ব। অবশেষে আজ বাতাসে শুধু ধ্বনিত হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ে নিহত হাজারো শিশুর ক্রন্দন।
No comments:
Post a Comment