বিথি আক্তার
"আমার বয়স ১৩ বছরের মতো হবে। আমি বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান, আমার আরো তিন বোন আছে কিন্তু আমাদের কোন ভাই নাই। আমার বড় বোন বয়স ১৬ বছরের মতো গার্মেন্টস-এ কাজ করতো, প্রায় এক বছরের বেশী হলো তার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বাবার নাম দুলাল বয়স ৪০ বছর। বর্তমানে সে কোন কাজ করতে পারে না কারন সে অসুস্থ। পূর্বে সে রিক্সা চালাত কিন্তু ৪বছর আগে সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোমরের ব্যাথার কারণে কোন কাজ করতে পারে না।
আমার মা গৃহপরিচারিকার (বুয়া) কাজ করেন এবং বলতে গেলে তিনিই একমাত্র উপর্জনকারী। নতুন বাজার থেকে পূর্বদিকে নূরের চালা মুড়ি ফ্যাক্টরির পাশে আমাদের বাসা। টিনসেট একটি ঘরের ছোট একটি রুম
ে আমরা সবাই থাকি - প্রতিমাসে ভাড়া দিতে হয় ১১০০ টাকা।
আমি দু বছরের মতো লেখা-পড়া করেছি। আমাদের এলাকায় একটি এন.জি.ও ছিল কিন্তু দু-বছর পড়ানোর পর গত জানুয়ারীতে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে আমি বাংলা পড়তে ও লিখতে পারি এবং অংক ও ইংরেজী অল্প অল্প পারি। খুব ইচ্ছে ছিল লেখা-পড়া করার কিন্তু কোথাও আর পড়া হলো না। বর্তমানে আমি প্রায় সারাদিন বাসায় থাকি এবং ঘরের কাজ করি। রান্না বান্না থেকে প্রায় সবই নিজেই করি। কাউকে না জানিয়ে আমি গার্মেন্টস চাকরীর জন্য গিয়েছিলামও কিন্তু ছোট বলে আমাকে কাজ দেয়নি। পূর্বে আমি গুলশানে ট্রাফিক সিগনালে ফুল বিক্রি করতাম। আমি এবং আমার আরো তিনজন বান্ধবী মিলে ফুল বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন একটু বড় হয়েছি বলে বাবা-মা ফুল বিক্রি করতে দেয় না। বাবা-মা এখন আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে। তারা কয়েক বার আমাকে বিয়ের কথা বলেছে। আমি কেঁদেছি এবং বলেছি তারা যদি আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায় তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব যেদিকে দু চোখ যায়।"
কুলসুমা
"আমার বয়স ১২ বছর। আমি বাবা-মার সবচেয়ে ছোট সন্তান। আমার বড় দুজন ভাই আছে। আমার বাবা নেই আমি যখন খুব ছোট তখন আমার বাবা মারা গেছেন। আমার মা আগে গৃহপরিচারিকার (বুয়া) কাজ করত কিন্তু বর্তমানে সে বৃদ্ধ এবং অসুস্থ কোন কাজ করতে পারেনা। আমার মেঝ ভাই একটি স্কুলে কাজ করে কিন্তু সে বিয়ে করে আলাদা থাকে। আমাদের কোন খোঁজ নেয় না। আমার বড় ভাই কোন কাজ করে না - সে মাদকাশক্ত এবং জুয়া খেলে। সে গাঁজা এবং হিরোইন খায়। সে আমাদের সাথে খায় না - গভীর রাত্রে ঘরে এসে ঘুমায় এবং দিনের বেলায় চলে যায়। সে আমাদের কোন টাকা দেয়না কিন্তু মা এবং আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। বলতে গেলে আমাকে সব খরচ বহন করিতে হয়। আমি আগে গুলশান-২ ট্রাফিক সিগনালে ফুল বিক্রি করতাম কিন্তু বেশী আয় করার জন্য আমি এখন টোকাইয়ের কাজ করি। রাস্তার পাশের ডাস্টবিনের ভিতর থেকে ময়লার কাগজ, পলিথিন ব্যাগ, বোতল, ক্যান ইত্যাদি সংগ্রহ করি এবং ভাঙ্গারী দোকানে বিক্রি করি। সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই কাজ করি- এতে প্রতি সপ্তাহে ২০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো আয় হয়। আমাকে প্রতিদিনের খাবার এবং অন্যান্য খরচ ছাড়াও প্রতিমাসে ১২০০ টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়। আমাদের বাসায় বিদ্যুতের সংযোগ থাকলেও বাড়ীওয়ালা রাত্রের বেলাই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখে।
আমি একটি এন.জি.ও স্কুলে দু-বছর লেখা-পড়া করেছি। আমি বাংলা পড়তে ও লিখতে পারি। অংক এবং ইংরেজী কিছু কিছু পারি। আমি স্কুলে ভালো ছাত্রী ছিলাম। দু - বছর পর গত জানুয়ারী মাসে স্কুল বন্ধ হলে আমার লেখা পড়াও বন্ধ হয়ে যায়।"
লাভলী আক্তার
"আমার নাম লাভলী আক্তার, বয়স ১৩ বছর। আমি বাবা-মার সবচেয়ে বড় সন্তান আমার একজন ছোট ভাই এবং একজন ছোট বোন আছে। আমার বাবা নিয়মিত রিক্সা চালাত কিন্তু দু-বছর আগে সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এখন পর্যন্ত সে কোনো কাজ করতে পারেনা। আমার বাবার নাম বাবু এবং তার বয়স ৪০ বছরের মতো হবে। আমার মা গৃহপরিচারিকার কাজ করে এবং বর্তমানে তিনিই আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। আমাদের গ্রামের বাড়ী ঢাকার ডেমরা কিন্তু সেখানে আমাদের কিছুই নেই। আমি আগে গুলশান-২ ট্রাফিক সিগনালে ফুল বিক্রি করতাম কিন্তু এখন বাবা-মা ফুল বিক্রি করতে যেতে দেয় না কারন তারা বলে আমি এখন বড় হয়ে গিয়াছি। তারা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিছুদিন ছেলে পক্ষ এসে দেখে গেছে শুনেছি ছেলে কোন এক গার্মেন্টসে চাকুরী করে। আমি এ বিয়েতে রাজি ছিলাম না, আমি অনেক কেঁদেছি এবং বলেছি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এখনো বাবা-মা আমাকে বিয়ের কথা প্রায়ই বলে যাতে আমি রাজি হই। আমার ইচ্ছে ছিল লেখা-পড়া করব এবং কমপক্ষে গার্মেন্টসে চাকুরী করব। একদিন আমার বান্ধবী বিথির সাথে একটি গার্মেন্টসে গিয়েছিলাম চাকুরী নেওয়ার জন্য কিন্তু আমাদের অল্প বয়স বলে চাকুরী দেয়নি। আমি কোন স্কুলে লেখাপড়া করিনি কিন্তু দু-বছর একটি এন.জি.ও স্কুলে পড়েছি। গত জানুয়ারী মাসে আমাদের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বাংলা এবং অংক লিখতে ও পড়তে পারি।"
রুবি আক্তার
"আমার নাম রুবি আক্তার বয়স ১৩ বছর। আমি বাবা-মার ছোট সন্তান, আমার বড় দুই ভাই এবং দুবোন আছে। আমার বড় দু-বোনের বিয়ে হয়েছে এবং তারা তাদের স্বামীর সাথে থাকে। আমার বড় ভাই রিক্সা চালায়, সেও বিয়ে করেছে এবং তার পরিবার নিয়ে আলাদা থাকে। আমার দ্বিতীয় বড় ভাই কোন কাজ করেনা সে নেশাখোর, জুয়াখেলে। সে গাঁজা, হিরোইন খায় এবং জুয়াখেলে। সে প্রায়ই আমাদের ঘর থেকে টাকা অথবা কোন জিনিস চুরি করে বিক্রি করে নেশা করে। মা এবং আমাকে মাঝে মাঝেই মারে। আমার বাবা অন্য আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র থাকে। মাঝে মাঝে বেড়াতে এলেও কোন খরচ দেয় না। আমার মা একজন ভিক্ষুক সে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ায়। আগে আমার মা বুয়ার কাজ করিত কিন্তু এখন সে খুব দুর্বল কাজ করতে পারেনা। সে ভিক্ষাও ঠিকমত করতে পারেনা।
আমি আগে ট্রাফিক সিগনালে ফুল বিক্রি করিতাম কিন্তু কয়েকটি কারনে এখন করিনা । ফুল সন্ধ্যার পরে বিক্রি করা যায় বেশি, কিন্তু আমার বান্ধবীরা কেউ আসেনা এবং এ কাজে বেশী আয় করা যায় না। কিন্তু আমাকে পরিবারের প্রায় সব খরচই বহন করতে হয়। আমাকে বাসা ভাড়া হিসাবে প্রতি মাসে ১১০০ টাকা দিতে হয়। মা বেশী বেশী ভিক্ষা করিতে পারেনা বলে আমাকেই প্রায় সব খরচই দিতে হয়। তাই আমি ফুল বিক্রি বাদ দিয়ে টোকাইয়ের কাজ করছি। গুলশান মার্কেটের বিভিন্ন রাস্তায় এবং ডাস্টবিনের ময়লা থেকে কাগজ, পলিথিন, ক্যান, বোতল ইত্যাদি সংগ্রহ করি এবং ভাঙ্গারী দোকানদারদের কাছে বিক্রি করি। প্রতিদিন কাজ করলে সপ্তাহে ২০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো আয় করা যায়।
কিছুদিন আগে বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য একটি ছেলে ঠিক করেছিলো তখন আমার বড় ভাই বিয়ে দিতে দেয়নি। আমার বড় ভাই বাবাকে বলেছে এত ছোট বয়সে বিয়ে দেওয়া ঠিক না। আমিও এখন বিয়ে করতে চাই না। আমি লেখা-পড়া শিখে গার্মেন্টস বা কোন অফিসে চাকুরী করিতে চাই। আমি প্রায় দু-বছর একটি এন.জি.ও স্কুলে লেখাপড়া করেছি। আমি বাংলা এবং অংক লিখতে ও পড়তে পারি এবং কিছু কিছু ইংরেজী পড়তে পারি।"
এই চারজন মেয়েই একই বাসায় আলাদা আলাদা রুম ভাড়া নিয়ে তাদের পরিবারের সাথে থাকে। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া ১১০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা। তাদের ঘরের চাল টিনের, বেড়া বাশেঁর এবং মেঝে কাচা মাটির। ১২ থেকে ১৪ টি পরিবারের জন্য রয়েছে দুটি অরক্ষিত টয়লেট, গোসলের জন্য খোলা জায়গা । তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিদ্যুৎ সংযোগ দিনের বেলা মাঝে মাঝে পেলে রাত্রে বিচ্ছিন্ন থাকে। মশা, দুর্গন্ধ এবং অসহ্য গরমে তাদের ঘুমানো খুবই কঠিন। বিদ্যুতের জন্য বাড়ীওয়ালাকে বললে বাড়ী থেকে চলে যেতে বলে। তাদের টয়লেটটি খোলা বলে খুব দুর্গন্ধ ছড়ায়।
এই চারজন ছোট বালিকা গুলশান-২ গোলচক্করে ফুল বিক্রি করত এবং ২০০৩ সালের দিকে আমাদের সাথে পরিচয় হয়েছিল। আমাদের নারী জীবনের চেয়ারম্যান ডঃ ক্যাথরিন বি-ওয়ার্ড যখনই বাংলাদেশে আসেন তখনই তাদের খোঁজ নেন। তাদেরকে সাহায্যও করে থাকেন এবং তাদের খুবই ভালবাসেন।
যেমন- এই চারজন বালিকাকে তাদের জীবনের স্বরনীয় কোন ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করিলে চারজনই একই একই দুটি ঘটনার কথা বর্ননা করেন।
প্রথমটি হলো: প্রথম যেদিন তাদের মধ্যে দু-জন ডঃ ক্যাথরিনের কাছে ফুল বিক্রি করিতে গেলে ফুল না নিয়ে প্রত্যেককে ১০০টাকা করে দেন।
দ্বিতীয়টি হলো: যেদিন তারা ডঃ ক্যাথরিনের অফিসে গিয়েছিল এবং তাদের সবাইকে খুবই ব্যায় বহুল রেষ্টুরেন্টে নিয়ে সুস্বাদু খাবার খাওয়াল। তাদের ভাষায় ম্যাডাম তাদের বাবা-মার চেয়েও বেশী আদর করেন এবং তারাও তাকে খুব ভালবাসেন।
No comments:
Post a Comment