Saturday, September 8, 2007

জীবনের কথা - নিলা সুলতানা

Title of this post: My life- Nila Sultana by M.G Rabbany

আমার নাম নিলা সুলতানা, বয়স ২২ বছরের মতআমার বাবা খুলনার একটি পাট কলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত এবং ১৯৮৪ সালের দিকে আমি সেখানে জন্মগ্রহন করি। তিনি সাপ্তাহিক ভিত্তিতে কাজ করতআমার দাদার বাড়ি হচ্ছে ফরিদপুর জেলায়আমার দাদার বাড়ি এবং নানার বাড়ি কাছাকাছি কিন্তু সেখানে সামান্য বাড়ী ভিটা ছাড়া কোন সম্পতি নেই ছোট সময় দাদার বাড়ী, নানার বাড়ীতে বছরে দুএকবার সাধারনত ঈদের ছুটিতে যাওয়া হতোআমার মা শুধু গৃহিণী হিসেবেই কাজ করতআমি খুলনার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েক বছর লেখাপড়া করেছিআর্থিক অস্বচ্ছলতা,অজ্ঞতা ইত্যাদি কারনে লেখপড়াকরা হয়নিকিন্তু এখন ঝুঝতে পাড়ি লেখাপড়ার মূল্য কত কিন্তু আফসোস ছাড়া কিছুই করার নেইআমরা তিন ভাই, দুই বোনদুই ভাই এক বোন বড় তারা ইতিমধ্যে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেবড় দুই ভাইই ঢাকায় রিক্সা চালায়তাদের আর্থিক অবস্থা এত ভাল নয় যে বাবা-মা কে সাহায্য করবে

সম্ভবত ১৯৯৩ সালে খুলনার জুটমিলটি হঠা বন্ধ হয়ে যায়তখন বাবা আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বেকার হয়ে পড়েগ্রামে ফিরে যাওয়ার উপায়ও নেইতাই নিরূপায় হয়ে তখন বাবা সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসেঢাকায় আসার পর বাবা প্রথম দিকে নির্মান শ্রমিক হিসেবে কাজ করিলেও পরে একটি বাসার দারোয়ান হিসেবে কাজ করেনঢাকায় আসার পর মাও বাবাকে আর্থিক ভাবে সাহায্যে করার জন্য একটি গার্মেন্টসে চাকুরী করেনপ্রায় এক বছর চাকুরী করার পর আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েনবর্তমানে বাবা কাজ করিতে পারে না এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছে

এখন আমি বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে থাকিছোট ভাই আয় করিতে পারে না, বর্তমানে গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে আমি আমার বাচ্ছাসহ অনেক দিন ধরেই তাদের সাথে থাকছি

আমার ২০০১ সালের দিকে আলাল নামের একটি ছেলের সাথে বিয়ে হয়তার বর্তমান বয়স ২৭ বছর তার বাড়ী পাবনা জেলায়, সেখানেই তার পরিবারের সবাই থাকেসে আমাদের এই এলাকায় থাকত এবং রিক্সা চালাতোআলাল নবম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে এবং দেখতেও বেশ সুশ্রী ছিলসে অন্য কোন কাজ পায়নি বলেই রিক্সা চালাতকিন্তু নিয়মিত রিক্সা চালাতে চাইত নাবিয়ে করার পর সে আমাকে নিয়ে একটি এক রুমের বাসা ভাড়া করেকিন্তু অলসতা এবং নিয়মিত রিক্সা চালাতনা বলে সে সংসার চালাতে পারত নামাঝে মাঝে আমার বাবা-মা আর্থিক ভাবে সাহায্য করতটাকার অভাবে মাঝে মাঝেই দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতোএরই মধ্যে আমি গর্ভবতী হয়ে পড়িআমাদের আরো খরচ বেড়ে গেলোএক পর্যায়ে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে আমি তার বাসা থেকে চলে আসি বাবা-মায়ের কাছেবাবা-মায়ের কাছে থাকা অবস্থায়ই আমার পুত্র সন্তান হয় ২০০৩ সালের শেষের দিকেএদিকে স্বামী রাগ করে তার গ্রামের বাড়ী চলে যায়তখন বাবা-মা ই আমাকে এবং সন্তানকে দেখাশুনা করতবাবা-মার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভাল ছিল নাভাইয়েরাও কেউ সাহায্য করিত নাবাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েআমাকে নানা রকম কথা শুনতে হতোটাকা পয়সার অভাবে আমাকে অনেক সমস্যায় ভূগতে হতোপরিবারের সবার কাছেই অতিরিক্ত হয়ে গেলামতখন আমি টাকা পয়সা আয় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম যদিও তখনও আমি পুরোপুরি সুস্থ ছিলাম নাতখন আমি কয়েকটি বাসায় খন্ড কালীন বুয়া হিসাবে কাজ করা শুরু করলামআমি খুব পরিশ্রম করিতে শুরু করিলাম আয় করার জন্যগৃহভৃত্য হিসাবে খুব পরিশ্রম করেও খুব বেশী আয় করা যেত নাতিন/চারটি বাসায় ১৩/১৪ ঘন্টা কাজ করে মাত্র ৯০০ টাকা পেতামতখন আমি কিছু বেশী আয় করার জন্য কত পরিশ্রম এবং কত সমস্যায় যে পড়েছিলাম তা ভাষায় ব্যাখ্যা করিতে পারিব নাআমাদের একই এলাকার কহিনুর নামে মাঝবয়সী একজন মহিলা থাকতো - সে আমাকে চিনত এবং আমার সমস্যা সম্পর্কেও অবহিত ছিলতার কাছেই আমি নারী জীবন সম্পর্কে এবং এর চেয়ারম্যানের মহানুভবতা সম্পর্কে জানতে পারলামকোহিনুর নারী জীবনের ছাত্রী ছিলআমি কোহিনুর আপাকে নারী জীবনে নিতে এবং এর চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করানোর জন্য অনুরোধ করলামআমি কোহিনুরের সাথেই নারী জীবন সংস্থায় গেলাম এবং এর কার্যক্রম দেখে খুবই আশ্চার্য হলামমনে হলো এখনো পৃথিবীতে কিছু সংস্থা এবং মানুষ সত্যি মানুষের জন্যই কাজ করেনারী জীবনে গিয়ে বাংলায় লেখাপড়া এবং দর্জির কাজ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হলো কারণ বাসায় দর্জির কাজ করে আয় করা যায় যা অন্য মানুষের বাসায় কাজ করার চেয়ে অনেক ভালো এবং সম্মানেরকিন্তু কিভাবে এবং কখন শিখবো টাকা আয় না করিতে পারলে তো আমাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হবেঅসুস্থ বাবা-মা বাচ্চা সবাইকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়তে হবেকোহিনুর আপা যেহেতু আমার সব সমস্যার কথা জানে সেই নারী জীবনের চেয়ারম্যানকে আমার সব সমস্যার কথা বললোসব কিছু শুনার পর তিনি আমাকে এমন সুবিধা দিলেন যে আমি নারী জীবন থেকে সব কিছু শিক্ষার সুযোগ পেলামকাজ শেখার পাশাপাশি আমার বেতনের ব্যবস্থা করিলেন যা সারাদিনের বুয়ার কাজের বেতনের চেয়ে অনেক বেশীএ রকম মহান মানুষ আমার জীবনে আসেনি

আমি ১০ই জুলাই ২০০৬ সালে নারী জীবনে এল.পি.সি ( লেখা-পড়া-চাকুরী ) হিসাবে ভর্তি হলামআমি বাংলা সেকশনে বাংলা এবং অংক শিখতে শুরু করলামযেহেতু আমি বাংলা কিছু কিছু জানতামই তাই শিখতে বেশী দিন লাগলো নাঅল্প দিনেই বাংলা-অংক-এবং কিছু ইংরেজী শব্দও শিখে ফেললামসুবিধা ছিল এই যে সারাদিন (অফিস সময়) আমার শেখার সুযোগ ছিলঅন্যদিকে চিন্তা মুক্ত ছিলাম পরিবারের ব্যয় নিয়েযা পেতাম তা দিয়ে ভালো মতোই চলে যেতবাংলা সেকশনের কোর্স শেষ করার পর পরই দর্জির কাজ শেখা শুরু করলাম এবং অল্প দিনেই সাফল্যের সাথে সব আইটেম তৈরী করা শিখে ফেললামসারাদিন অফিসে থাকতে হতো বলে পর্যাপ্ত অনুশীলন করার সুযোগ পেতামনারী জীবন থেকে প্রতি মাসে লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি ৩৭০০ টাকা পেতামতখন বাবা-মা সহ অন্যরাও আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতো এবং তারা আমার উপর খুশি ছিলঅন্যদিকে আমার স্বামী আবার ঢাকায় এলোএবং সে মাঝে মাঝেই আমার ছেলেকে দেখতো আসতো নানা রকম জিনিস নিয়েকিন্তু আমি তাকে পাত্তা দিতাম নাআমার স্বামী একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে বিক্রয় কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছেতাকে আর রিক্সা চালাতে হয়নাদীর্ঘ ছয় মাস আমি নারী জীবনে শেখার সুযোগ পেয়েছিএই সময়ের মধ্যে বাংলা এবং টেইলরিং কোর্স সমাপ্ত করেছিতাছাড়াও আমি অফিস ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে প্রশিক্ষন নিয়েছিআমার স্বপ্ন ছিল গৃহে বসে দর্জির কাজ করাকিন্তু সেলাই মেশিন ও ব্যবসা শুরু করার জন্য বেশ কিছু টাকার প্রয়োজনকিন্তু আমার কাছে তা ছিলনাতাই আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নারী জীবনের চেয়ারম্যানকে সহযোগীতা করার জন্য অনুরোধ করিআমার তৈরী ব্যবসার পরিকল্পনার বাজেট অনুযায়ী তিনি আমাকে একটি নতুন সেলাই মেশিন এবং আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার জন্য কিছু নগদ টাকা দেনইতিমধ্যে আমার স্বামী আমার কাছে ফিরে এসেছেএখনো আমরা আমার বাবা-মার সাথেই থাকছিআমার স্বামী চাকুরী করছে এবং আমি ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ করছিএভাবে যা আয় হয় তা দিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া নিলে আমাদের চলতে অসুবিধা হবেস্বামীর সাথে আলোচনা করে গত আগষ্ট,২০০৭ সালে আমি একটি গার্মেন্টসে চাকুরী নেইসেলাই কাজ এবং লেখাপড়া জানি বলে চাকুরী নিতে পেরেছি সহজেইকিন্তু অভিজ্ঞতা নেই বলে তিন মাস আমাকে হেলপার হিসাবে চাকুরী করিতে হবেগার্মেন্টেসের নিয়োগ কর্তা আমাকে কথা দিয়েছেন তিন মাস কাজ করার পরে আমার বেতন বৃদ্ধি করিবেনবর্তমানে আমার বেতন ধরা হয়েছে ১২৫০ টাকাগার্মেন্টেস থেকে বাসায় ফিরে আমি সেলাইয়ের কাজ করিআমি মনে করি নারী জীবন থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি অনেক কিছু জানতে পেরেছিআমি নারী জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ

1 comment:

Unknown said...

সংগ্রামী মানুষ সবার জন্য অনুকরণীয়। আমাদেরদেশে অনেক মানুষ সংগ্রাম করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। জাতির উন্নতির জন্য আমাদের উচিত সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা ।