সবেমাত্র এইচ ,এস,সি পাস করেছি। আমি ও শিল্পী, আমরা দুই বান্ধবী একসাথে চলতাম, কোথাও যেতে হলে একসাথে যেতাম, দুই জনের মধ্যে ছিল গভীর মিল, কারন আমরা দুই জন ৬ষ্ট শ্রেনী থেকে এইচ.এস.সি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি। এক এক করে দুই জনে মনে করলাম একসাথে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবো। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দুইজনেরই একই সমস্যা। টাকার জন্য কোন বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আমি এবং আমার ক্লাসের অন্য সব বান্ধবীদের তুলনায় শিল্পী করেছিল ভাল রেজাল্ট। টাকার সমস্যার কারনে থেমে গেলো দুইজনের চলার পথ। ক্লাসের মধ্যে শিল্পী ছিল সবচেয়ে গরীব ও মেধাবী ছাত্রী। ওর বাবা কোন রকম মাছ বিক্রি করে সংসার চালাত। ভাল ছাত্রী ছিল বলে স্কুলও কলেজ এর তহবিল থেকে ওকে অনেক সাহায্য করত। অধিকাংশ সময় সহায্যের উপর নির্ভর করে ওর লেখা পড়া চলেতো। আমি ঐ বছরেই বি.এ ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু শিল্পী ভর্তি হতে পারল না । ওর বাবা মনে করল, মেয়েকে আরও যদি পড়ানো হয় তবে, তার মেয়েকে ভাল একটা পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারবে না। কারন সে একজন গরীব। তাই সে তার মেয়েকে পড়াবে না। আমি বুঝালাম, “বিয়ে হওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু ও শিক্ষিত হলে ভাল চাকুরী করতে পারবে। আপনার সংসারের অভাব অনটন দুর করে দেবে”।
ওর বাবা বলল, “মেয়ে মানুষ কি করবে? ছেলে হলে একটা কথা ছিল।”
দেখা করার চেষ্টা কারলাম। কিন্তু দেখা হলো না ওর সাথে। তার আগই আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কোন ডাক্তার আমার রোগ ধরতে পারল না। আমি ধীরে ধীরে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। চিকিৎসা নিতে চলে এলাম ঢাকয়। কিছুতেই ভাল হলাম না। বনধ হয়ে গেলো আমার লেখাপড়া। থেমে গেলো আমার জীবন। বাধা পড়ে গেলো দুই জনের চলার পথ। এরই মাঝে একটু সুস্থ হলাম। ফিরে গেলাম দেশে একদিন হাটাতে, হাটতে ওদের বাড়িতে গেলাম। আমাদের গ্রামেই ওদের বাড়ি। ওর সংগে দেখা হল না। ওদের বাড়িতে গিয়ে যা শুনলাম। তাতে ওর প্রতি যে রাগ ছিল তা ধুয়ে মুছে গেলো শুরু হল সমাজের প্রতি ঘৃনা। দারিদ্র্যের প্রতি ঘৃনা। দারিদ্র মানুষকে কোনদিন সুখ তো দেয়ই না বরং সুন্দর সাজানো একটা জীবন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। আমাদের দেশে যৌতুক অতি সাধারন ও গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দেশের দারিদ্র বাবারা মনে করেন মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া হল একটা অভিশাপ। জন্মের পরে একটা মেয়ের পিছনে কত কিছু খরচ করতে হয় তার বাবাকে। তার জীবন পরিচালনা থেকে শুরু করে লেখাপড়া এবং দায়িত্ব, কত খরচ। একটা ছেলের বেলায় ও এই। কোন কিছুর কমতি নেই। কিন্তু বিয়ের সময় ছেলের বেলায় কোন নিয়ম নেই। অথচ মেয়ের বেলায় কত রকম ধান্দাবাজী। শিল্পীর বাবা এতই গরীব ছিল যে, মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে নগদ টাকা দেওয়া তো দুরের কথা সাধারনত ভাত খাওয়ার একটা থালা দেবে সেটাও দেয়ার সমর্থ তার ছিলনা।
আমাদের দেশে এমন একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, শিক্ষিত মেয়ের জন্য একটা শিক্ষিত পাত্র খুঁজতে হলে তাকে সেভাবে সাজিয়ে দিতে হবে। ছেলেকে দিতে হবে, ছেলের ঘর সাজিয়ে দিতে হবে। অতএব বাধ্য হয়ে শিল্পির মত এমন অনেক প্রতিভাবান মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে ও অশিক্ষিতের সাথে সারাটা জীবন কাটাতে হচ্ছে। পৃথিবী সম্পর্কে অনেক কিছু জানা থাকলেও তাকে বাস করতে হচ্ছে ঘরের কোনে। যা শুধুমাত্র তার জীবনকে বিষন্ন করে তোলে। বাবাকে যাতে বসত ভিটেটুকু না হারাতে হয় সে জন্য শিল্পীকে বিক্রি করে দিতে হয়েছে অশিক্ষিত একটি স্বামী ও স্বামীর সংসার। না আর হয় নি ওর সাথে দেখা । আমি চলে এলাম ঢাকয়। ওর জন্য আমার মনটা এখনো কাঁদে। হয়ত ওর স্বামীর টাকা পয়সা আছে। শিল্পী সুখেই আছে । কিন্তু শিল্পী কি মানসিক দিক দিয়ে সুখী? বাংলাদেশে এইড্স রোগের বিজ্ঞাপনের স্লোগানটি হল “বাঁচতে হলে জানতে হবে”। এ ব্যাপারে সবাই অবগত আছে। এটা থেকে সবাই বাঁচতে চায়, কিন্তু আমাদের দেশের প্রতিটা নারীর জীবনে এই যে যৌতুক নামের জীবানুটা ঢুকে গেছে। এ থেকে বাঁচার উপায় কি? বাংলাদেশ কি দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পাবে না। বাংলাদেশের নারীর কি যৌতুক থেকে মুক্তি পাবে না। আজ আমার বান্ধবীর হয়েছে। কাল আমার হবে। পরশু আর এক জনের হবে। সমাজের সমস্ত বিত্তবান এবং শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন বিভিন্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তারা কি বাংলাদেশকে এই দারিদ্রতা ও যৌতুকের মত রোগ থেকে বাঁচাতে পারবে না?................
No comments:
Post a Comment