আমার নাম মনোয়ারা বেগম। আমি ঢাকার আড়াইহাজার থানায় জন্মগ্রহন করি। আমার বাবা ছিলেন চাকুরীজীবি আর মা ছিলেন গৃহিনী। আমরা দুই বোন, এক ভাই এবং আমি আমার বাবা-মায়ের বড় সন্তান। যখন আমার বয়স মাত্র আট বছর তখন আমার বাবা মারা যায়। আমার বাবার মূত্যুর পর আমার পরিবার চরমভাবে অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে পড়ল। আমার মা আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেনি। আমার এক প্রতিবেশী (আমি তাকে খালা ঢাকি) আমাকে ঢাকা নিয়ে আসে এবং আমাকে একটি বাসায় কাজ দেয়। প্রতিমাসে আমার বেতন ছিল মাত্র ৫০ টাকা। মাসের শেষে এই টাকা আমি আমার মায়ের জন্য পাঠিয়ে দিতাম। প্রায় ৫ বছরের মত আমি সেখানে কাজ করেছিলাম। যখন আমার বয়স ১৩ তখন একজন দোকানদার(আমি যেখানে কাজ করতাম তার পাশেই ছিল তার দোকান) আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রথমে আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেই এবং তাকে বলি যে আমি গরীব ঘরের মেয়ে। সে তার উত্তরে বলল, এমন কোন নিয়ম তো নেই যে গরীব ঘরের মেয়েরা বিয়ে করতে পারবে না। তার ভাল ব্যবহার এবং আবেগ দেখে আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি এবং তাকে ভালবেসে ফেলি।
আমরা আমার মায়ের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করে ফেলি। বিয়ের দুইদিন পরে আমরা সিন্ধান্ত নিলাম যে আমরা আমার শশুর বাড়ি ব্রাম্মনবাড়িয়া চলে যাব। আমার শশুর বাড়ি পৌঁছানোর পর থেকেই শুরু হল আমার কষ্টের জীবন। আমাদের বিয়েকে ভিত্তি করে আমাকে অনেক বাজে কথা শুনতে হয়েছে। আমার শাশুরী এবং আমার ননদ আমার সাথে কোন কারন ছাড়াই খারাপ আচরন করতে শুরু করল। আমার শশুর বাড়িতে আমি এমন একজনকে পেলাম না যে আমাকে পছন্দ করত। তারা আমাকে শারিরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে শুরু করল। তাদের কোন আর্থিক সমস্যা ছিলনা কিন্তু তারপরও তারা আমাকে পরিমিত খাবার এবং পরিধানের জন্য কাপড় চোপড় দিত না। আমার স্বামী সবই জানত কিন্তু বাবা মার অমতে বিয়ে করার কারনে সে কাউকে কিছু বলতে পারত না।
আমাদের বিয়ের কিছুদিন পরে, আমি আমার মায়ের সাথে দেখা করার জন্য আমাদের বাড়িতে আসি। মায়ের সাথে কিছুদিন ছিলাম কিন্তু আমার শশুর বাড়ি থেকে কেউ আমার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি। কিছুদিন পরে আমার স্বামীর চাচী সম্পর্কের এক প্রতিবেশী আমাদের বাড়িতে যায় এবং আমাকে তার সঙ্গে করে নিয়ে আসে, এটাই ছিল আমার অপরাধ। শাস্তি স্বরূপ সারা রাত্রি আমাকে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তারা কেউ ঘরের দরজা খুলেনি। পরেরদিন সকালে গ্রামের লোকজন এব্যাপারে জানতে আসে এবং গ্রামের লোকদের মুখ বন্ধ করার জন্য আমার শশুর আমাকে ঘরে জায়গা দেয় (এটা ছিল লোক দেখানো)। এই ঘটনার পরে তারা তাদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাইরের লোকেরা কিছুই জানত না।
বিয়ের এক বছর পর আমি গর্ভবতী হই। কিন্তু গর্ভকালীন সময়ে আমি পাইনি পরিপূর্ন বিশ্রাম এবং খাবার; বিপরীতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এই কষ্টের দিনগুলো পারি দিয়ে আমি একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেই। জন্মের ২ দিন পর থেকেই আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পরে। কিন্তু কেউ তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি এবং অবশেষে সে মারা যায়। হয়তবা অসতর্কতা এবং কঠিন পরিশ্রম করার কারনে আমার মেয়ে জন্মের দুইদিন পরে মারা যায়। কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়া এটা হয়ে দাড়াঁল আমার আরেকটা অপরাধ এবং এই কারনে অনান্যদের সাথে আমার উপর চড়াঁও হল স্বামীর নির্যাতনও। আমার স্বামী কোন কারন ছাড়াই আমার উপর রাগ করত। সে ছিল বেকার কারণ বিয়ের পর আমার শশুর তার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছিল।
একদিন আমার স্বামী তার বাবাকে অনুরোধ করে টাকা দিয়ে তাকে বিদেশ পাঠানোর জন্য। আমার শশুর বলে, “আমরা আশা করেছিলাম তোমার শশুর বাড়ি থেকে যৌতুক নিব। আর যদি আমরা যৌতুক নিতে পারতাম তবে তোমার ভবিষৎতের জন্য আমাদেরকে কোন চিন্তা করতে হত না কিন্তু তুমি গরীব ঘরের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছ এবং কোন যৌতুক নাওনি”। আমার শশুর খুবই রাগান্বিত ছিল এবং বলেছিল যে সে কোন টাকা পয়সা দিবে না। অনেক অনুরোধের পর আমার শশুর টাকা দিতে রাজী হলেন এবং আমার স্বামী মালয়শিয়া চলে যায়।
আমার স্বামী মালয়শিয়াতে যাওয়ার পর আমি আমার শশুর বাড়িতেই ছিলাম। তারা পুনুরায় আমাকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করতে শুরু করল, আমার শাশুরী চাইতেন আমি যেন তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। তারা সব সময়ই চাইত আমি যেন তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসি এবং তারা যেন আবার তাদের ছেলেকে বিয়ে করাতে পারে।
জাল বিশার কারনে আমার স্বামী বেশিদিন মালয়শিয়ায় থাকতে পারেনি। তিনমাস পরেই সে বাংলাদেশে ফিরে আসে। মালয়শিয়া থেকে ফিরে আসার কারনে সে খুব হতাস ছিল। আমার শশুর বাড়ির লোকজন আমাকে অপবাদ দিতে শুরু করল এবং বলল আমি অপয়া। এইসব নির্যাতন সহ্য করেও আমি আমার স্বামীর বাড়িতেই ছিলাম এবং আবার গর্ভবতী হলাম। আমি আমার অনাগত সন্তানকে রক্ষা করার জন্য কাউকে কিছু না বলে তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসি।
আমার শশুর বাড়ি থেকে আমি আমার মায়ের কাছে চলে আসি কিন্তু আসার পর কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। কিছুদিন পরে আমি একটা ছেলে সন্তানের জন্ম দিলাম। সেই সময়টা ছিল আমার জীবনের সবচাইতে সুখের সময় কিন্তু এই সুখ বেশিক্ষন স্থায়ী হল না কারণ সন্তানের বাবার কথা ভেবে মন খারাপ হয়েগিয়েছিল। কারন সে সেখানে ছিল না। আমার বাবার মূত্যুর পর মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন কারন আমার ভাইটি তখন ছোট ছিল। আমাদের পরিবার ছিল গরীব তাই আমি অনুভব করতে লাগলাম যে আমি তাদের জন্য একটা বুঝা। যখন আমার ছেলের বয়স ৬ মাস তখন আমার এক প্রতিবেশীর সাথে ঢাকায় চলে আসি এবং আমার এক আত্মীর বাসায় আশ্রয় নিই। ঢাকা শহরটা আমার কাছে অপরিচিত ছিল এবং আমি বুঝতে পারছিলাম না কোথায় গেলে আমি কাজ পাব। আমার আত্মীয়ের এক প্রতিবেশীর সহযোগিতায় আমি গার্মেন্টেসে কাজ নিলাম এবং আমার বেতন ছিল মাত্র ৩০০ টাকা। আমাকে ওভারটাইম ও করতে হয়েছে। কাজ পাওয়ার পর আমি আমার মা ও ছোট ভাইকে ঢাকায় নিয়ে আসি এবং আমরা একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। আমার স্বামী আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করেনি এমনকি ছেলেকে পর্যন্ত দেখতে আসেনি।
অনেকদিন পরে আমার স্বামী আমাদের সাথে দেখা করার জন্য গ্রামের বাড়িতে যায় কিন্তু সেখানে আমাদেরকে পায়নি যেহেতু আমরা ঢাকায় ছিলাম। পরে সে আমাদের ঠিকানা পায় এবং আমাদের প্রতিবেশীকে নিয়ে ঢাকায় আসে। আমার স্বামী আমার কাছে আসে এবং তার পূর্বের খারাপ আচরনের জন্য ক্ষমা চায়। আমি তাকে ক্ষমা করে দেই কারন আমি তাকে অনেক ভালবাসি। সে একটা গার্মেন্টসে চাকুরী নেয়। তার আয় ছিল খুবই কম। আমাদের পরিবারের জন্য বেশি অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে আমাদের কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। কয়েক মাস পর আমার স্বামী গার্মেন্টসের কাজ ছেড়ে দিয়ে একটি ট্রাবেল এজেন্সিতে কাজ নেয়। এখন তার উপার্জন আগের চেয়ে অনেক ভাল। এখন আমরা আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। আমি গার্মেন্টসের কাজ ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি দুই ছেলে সন্তানের মা। আমি আমার ছেলেদেরকে লেখাপড়া শিখাতে চাই।
আমি আমার এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে নারী জীবনের কথা জানতে পারি। নারী জীবনে আসার পর আমি এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী হই। আমি অশিক্ষিত ছিলাম কিন্তু আত্মবিশ্বাস ছিল যে আমি শিখতে পারব এবং এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে নারী জীবনের বাংলা শাখায় ভর্তি হয়ে যাই। আমার একটি স্বপ্ন আছে, নারী জীবন থেকে প্রশিক্ষণ শেষে আমি টেইলরিং বিজনেস্ করতে চাই। আমি আমার পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে চাই। পরিবারে আমার স্বামী সকল কাজের সিদ্বান্ত নেয়। আমার মতামতের তেমন কোন মূল্যই থাকে না কিন্তু আমি মনে করি যদি আমি আমার পরিবারকে অর্থিক দিক থেকে সাহায্য করতে পারি তখন হয়ত সবাই আমার মতামতের মূল্যায়ন করবে। হয়তবা তখন আমার স্বামী আমার মতামতকে প্রাদান্য দিবে। এখন আমি বাংলায় লিখতে, পড়তে ও বাক্য তৈরি করতে পারি, ছোট ছোট কিছু ইংরেজী শব্দ পড়তে ও তৈরি করতে পারি এবং ছোট যোগ, বিয়োগ ও গুন করতে পারি।
আমি নারী জীবনের সকল ডোনারদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং ধন্যবাদ জানাচ্ছি নারী জীবনের মা-কে (প্রতিষ্ঠাতা) যে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং আমাদের শেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
No comments:
Post a Comment