অনেক দিনের একটা ইচ্ছা ছিল নার্সিং র্কোস শেখার। ইচ্ছা পূরন ও হয়েছে। আমি ছিলাম নারী জীবন প্রজেক্টের একজন নিয়মিত ছাত্রী এবং বাংলা ব্লগের একজন নিয়মিত লেখিকা। সব ছেড়ে চলে এলাম নার্সিং র্কোস শিখতে কুমিল্লার ব্রাম্মনবাড়িয়ায়, একটা অপরিচিত যায়গা। প্রথম প্রথম সমস্যা হচ্ছিল। এখন একটু দ্বিধাবোধ কেটে গেছে। তো যাই হোক। আমি যেখানে থাকি এটা একটা হাসপাতাল। নতুন হাসপাতাল বলে রোগীর সংখ্যা কম। দিনে ১০-১২টা রুগী আসে। আলাদা কোন র্নাস নেই। আমরা এখানে শিখি এবং পাশাপাশি র্নাসিং এর দায়িত্ব পালন করি। বিভিন্ন ধরনের রুগী আসে। তাদের সেবা করি। ভালই লাগে।
কিছু দিন আগে সকালে একটা রুগী এসেছে। দৌড়ে গেলাম রুগীটাকে দেখতে। প্রয়োজন মত সেবা দেয়াও শুরু করলাম। রোগীটি ছিল মহিলা। প্রথমবস্থায় বুঝতে পারিনি যে রোগীটির কি হয়েছে। কিন্তু পরে জানতে পারলাম মহিলাটি স্বামী ও শ্বাশুড়ীর নির্যাতনের স্বীকার। তাকে এত পরিমানে মারধর করেছে যার ফলে তার জীবন নিয়ে টানাটানি। মহিলাটিকে যথেষ্ট পরিমানে চেষ্টা করলাম সুস্থ করে তুলতে। কিন্তু পারলাম না ।আমাদের ডাক্তার তাকে শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু পাষন্ড স্বামী তা মেনে নিলো না। বলল, “আপনারা যা পারেন তাই করেন। না পারলে বলেন আমি বাড়ি নিয়ে যাই।” ডাক্তার বলল, “আপনার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ। এই মুহুর্তে বাড়ি নিয়ে গেলে কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।” লোকটি বলল,”ঘটুক সমস্যা নাই”। স্যার কিছু না বলে আরেকটা রুগী দেখতে চলে গেল। আমি ও আমার সাথে যারা আছে আমরা রুগীটির কাছে থাকলাম। আমি রোগীটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার এঅবস্থা কিভাবে হয়েছে। রোগীটি কথা বলতে পারছে না, শুধু চোখের পানি ফেলছে আর বলছে আমাকে খুব মেরেছে। তার মুখ থেকে কোন কথা বেড়োচ্ছে না । অবলা নির্যাতিত নারীদের জীবনে কোন স্বাধীনতা নেই। আছে শুধু একটি স্বাধীনতা আর তা হল চোখের জল ফেলা। আর কিছু বলতে হল না তাকে আমি বুঝতে পারলাম ইনি একজন স্বামীর নির্যাতনের স্বীকার। সান্তনা দেয়ার ভাষা ছিল না। তবু ও যেহেতু সেবিকার পোষাক পড়েছি সেহেতু কিছু না কিছু সান্তনা দিতে তো হবেই তাই সান্তনা দিলাম। জরুরি বিভাগে রোগীটির স্যালাইন চলছে। রুম থেকে হাসপাতালের বারান্দায় এসে দেখি মহিলার সেই পাষন্ড স্বামী দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনার স্ত্রীর সমস্যাটা কি? লোকটি বলল, “কি আর সমস্যা, ওরে পেত্নিতে পাইছে, অয় সারা জীবন আমারে জালাইছে। খালি খালি কোন কারণ ছাড়াই অজ্ঞান হইয়া যায়।” তখন আমার খুব রাগ হচ্ছিল। আমি তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। বলে ফেললাম এটা কোন কথা? আপনি এখনো পেত্নিতে বিশ্বাস করেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম , “এধরনের বাজে কথা রোগীর সামনে বলা ঠিক না। আপনি তার স্বামী, আপনি যদি তাকে সান্তনা না দেন তবে কে দেবে?” আপনি সবসময় তার পাশে থাকবেন এবং স্যার যেটা বলল সেটা করেন, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। এই বলে আমি চলে এলাম রিসিপসনের রুমে। ঐ যে আগেই বলেছি এটা নতুন হাসপাতাল তাই রিসিপসনের জন্য আলাদা কোন লোক নেই। অবশ্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। যাই হোক আমি রিসিপসনে গিয়ে বসলাম। ওখানে আরো ও মেয়েরা ছিল। গিয়ে দেখি মধ্য বয়স্ক একজন পুরুষ ও মহিলা এবং ছোট একটা বাচ্চা ওখানে বসে আছে। তারপর জানতে পারলাম যে তারা অসুস্থ মহিলার বাবা এবং মা। তারা উভয়েই কাদঁছে। আমি ও আমার রুমমেট তাকে সান্তনা দিলাম এবং বললাম, আপনার মেয়েকে কি সবসময় এরকম অত্যাচার করে? তিনি বললেন “হ সব সময়ই করে, বিয়ার পরেততেই এমন করে।” তখন আমার রুমমেট জোরে চেঁচিয়ে বলল, “আপনারা এর পদক্ষেপ নেন না কেন?” তারা বলল, “শুধু মাত্র এই নাতিটার মুখের দিকে তাকাইয়া সহ্য কইরা আছি।” কাথাটা শুনে একবার ইচ্ছে হল আরও কিছু বলি কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। এর মধ্যেই পাষন্ড সেই লোকটি এসে হয়ত বা আমাদের সব কথা শুনে ফেলেছিল। তাই তার শ্বাশুড়ীকে ধমক দিয়ে বলল, “এই বেটি এহেনে কি?” মেয়ে জামাইয়ের কথায় মহিলাটি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে ওঠে চলে গেলো। লোকটি আরও অনেক কটু কথা বলল তার শ্বশুর এবং শ্বাশুড়ীকে। আমাদের বলার কিছু ছিল না। শুধু পাষন্ড লোকের পাষন্ডতম ব্যবহারগুলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলাম। ঐ এলাকার কিছু মেয়ে আছে আমাদের সাথে নার্সিং শেখে। ওরা বলল লোকটি নাকি খুব খারাপ। বড় ছোট মানে না প্রচন্ড বেয়াদপ।
৩০-মিনিট সময় যেতে না যেতেই দেখলাম মহিলাটিকে রিক্সায় তুলছে। দেখে খুশি হলাম ভাবলাম সদর হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাগ্য যখন খারাপ হয় তখন ভাগ্যকে ভাল করার কোন রাস্তা থাকে না। কিছুক্ষণ পর জানলাম ওনাকে সদর হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম মহিলাটির ভাগ্যে শুধু নির্যাতন জুটলো কিন্তু সু-চিকিৎসা জুটলো না। একেই কি বলে নারীর অধিকার? এ কেমন অধিকার যার ফলাফল শুধু নির্যাতন অন্যায়, অত্যাচার, অবজ্ঞা আর অবহেলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কথা আমার মনে পড়ে গেল-
“অবহেলিত অসহায় নারীদের
বিচারের বানি নিরবে নিভৃতে কাঁদে”
No comments:
Post a Comment